'গোপালের পড়া’ সুকুমার রায়


মোঃ আসাদুজ্জামান

'গোপালের পড়া' সুকুমার রায়
দুপুরের খাওয়া শেষ হ‌‌ইতেই গোপাল অত্যন্ত ভালোমানুষের মতন মুখ করিয়া দু-একখানা পড়ার ব‌‌ই হাতে ল‌‌ইয়া তিনতলায় চলিল। মামা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরে গোপলা, এই দুপুর রোদে কোথায় যাচ্ছিস?” গোপাল বলিল, “তিনতলায় পড়তে যাচ্ছি।”

মামা— “পড়বি তো তিনতলায় কেন? এখানে বসে পড় না।”
গোপাল— “এখানে লোকজন যাওয়া-আসা করে, ভোলা গোলমাল করে, পড়বার সুবিধা হয় না।”
মামা— “আচ্ছা, যা মন দিয়ে পড়গে।”
গোপাল চলিয়া গেল, মামাও মনে মনে একটু খুশি হ‌‌ইয়া বলিলেন, “যাক, ছেলেটার পড়াশুনোয় মন আছে।”
 
এমন সময় ভোলাবাবুর প্রবেশ- বয়স তিন কি চার, সকলের খুব আদুরে। সে আসিয়াই বলিল, “দাদা ক‌‌ই গেল?” মামা বলিলেন, “দাদা এখন তিনতলায় পড়াশুনা করছে, তুমি এইখানে বসে খেলা কর।”

ভোলা তৎ‌ক্ষনাৎ‌ মেঝের উপর বসিয়া প্রশ্ন আরম্ভ করিল, ‘দাদা কেন পড়াশুনা করছে, পড়াশুনা করলে কি হয়? কি করে পড়াশুনা করে?’ ইত্যাদি। মামার তখন কাগজ পড়িবার ইচ্ছা, তিনি প্রশ্নের চোটে অস্থির হ‌‌ইয়া শেষটায় বলিলেন, “আচ্ছা ভোলাবাবু, তুমি ভোজিয়ার সঙ্গে খেলা কর গিয়ে, বিকেলে তোমায় লজেঞ্চুস এনে দেব।” ভোলা চলিয়া গেল।

আধঘণ্টা পর ভোলাবাবুর পুনঃপ্রবেশ। সে আসিয়াই বলিল, “মামা, আমিও পড়াশুনা করব।”
মামা বলিলেন, “বেশ তো আর একটু বড় হও, তোমায় রঙচঙে সব পড়ার ব‌‌ই কিনে এনে দেব।”
ভোলা— “না সেরকম পড়াশুনা নয়, দাদা যে রকম পড়াশুনা করে সেইরকম।”
মামা— “সে আবার কি রে?”
ভোলা— “হ্যাঁ, সেই যে পাতলা-পাতলা রঙিন কাগজ থাকে আর কাঠি থাকে, আর কাগজে আঠা মাখায় আর তার মধ্যে কাঠি লাগায়, সেই রকম।”

দাদার পড়াশুনার বর্ণনা শুনিয়া মামার চক্ষু স্থির হ‌‌ইয়া গেল। তিনি আস্তে আস্তে পা টিপিয়া টিপিয়া তিনতলায় উঠিলেন, চুপি চুপি ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া দেখিলেন, তাঁর ধনুর্ধর ভাগ্নেটি জানালার সামনে বসিয়া একমনে ঘুড়ি বানাইতেছে। ব‌‌ই দুটি ঠিক দরজার কাছে তক্তপোশের উপর পড়িয়া আছে। মামা অতি সাবধানে ব‌‌ই দুখানা দখল করিয়া নিচে নামিয়া আসিলেন।

খানিক পরে গোপালচন্দ্রের ডাক পড়িল। গোপাল আসিতেই মামা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর ছুটির আর কদিন বাকি আছে?”
গোপাল বলিল, “আঠারো দিন।”
মামা— “বেশ পড়াশুনা করছিস তো? না কেবল ফাঁকি দিচ্ছিস?”
গোপাল— “না, এইতো এতক্ষণ পড়ছিলাম।”
মামা— “কি ব‌‌ই পড়ছিলি?”
গোপাল— “সংস্কৃত।”
মামা— “সংস্কৃত পড়তে বুঝি ব‌‌ই লাগে না? আর অনেকগুলো পাতলা কাগজ, আঠা আর কাঠি নিয়ে নানা রকম কারিকুরি করার দরকার হয়?”
গোপালের চক্ষু তো স্থির ! মামা বলে কি? সে একেবারে হতভম্ব হ‌‌ইয়া হাঁ করিয়া মামার দিকে তাকাইয়া রহিল। মামা বলিলেন, “ব‌‌ই কোথায়?”
গোপাল বলিল, “তিনতলায়।”

মামা ব‌‌ই বাহির করিয়া বলিলেন, “এগুলো কি?” তারপর তাহার কানে ধরিয়া ঘরের এক কোণে বসাইয়া দিলেন। গোপালের ঘুড়ি লাটাই সুতো ইত্যাদি সরঞ্জাম আঠারো দিনের জন্য মামার জিম্মায় বন্ধ রহিল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পেটুক – সুকুমার রায়