জুতার গল্প
জুতার গল্প
অমিত কুমার কুণ্ডু
১৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০
অঙ্কন : প্রসূন
অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে সন্দেশ নামে এক রাজা ছিলেন। লোকমুখে শোনা যায়, রাজা ছোটবেলায় খুব সন্দেশ খেতে ভালোবাসতেন। সেই থেকে রাজার রাজকীয় নাম বদল হয়ে রাজ্যময় ছড়িয়ে গেল সন্দেশ নামটা। রাজার নাম সন্দেশ হলে কী হবে? রাজার আচরণে কোনো মিষ্টতা নেই। রাজা যেমন বোকা, তেমনি গোঁয়ার, তেমনি মূর্খ ও খামখেয়ালি। মনে কোনো দয়ামায়া নেই। মাথায় কোনো বুদ্ধিশুদ্ধিও কম। রাজ্যের সবাই তাঁর ভয়ে কাঁপে। রাজা কখন যে কী করবেন, তা কেউ আঁচ করতে পারে না। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব কাজ করে বসেন, তা নিয়ে সভাসদদের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে হয়। কখনো তিনি গায়কদের গান শোনাতে ডেকে আনেন। দিনের পর দিন চলে গানের আসর। কখনো পালোয়ানদের ধরে আনেন। তাদের নিয়ে চলে কুস্তি প্রতিযোগিতা। কখনো তেজি ষাঁড় ধরে আনেন। চলে ষাঁড়ের লড়াই। আবার কখনো সদলবলে ঘুরতে যান দূরে কোথাও।
কী এক খেয়ালে একদিন রাজার মনে হলো, গহিন বনে শিকার করতে যাবেন। সঙ্গে সঙ্গে পাইক-পেয়াদা নিয়ে সদলবলে বনের পথে রওনা দিলেন। কত ঘোড়া, কত আয়োজন, কত মানুষজন তার কোনো গোনা-গুনতি নেই। রাজা যেতে যেতে শহরের শেষ মাথায় এসে পড়লেন। হঠাৎ কিছু ঝুপড়ি ঘর দেখে আর সেখান থেকে আসা কটু গন্ধ পেয়ে সভাসদদের কাছে জানতে চাইলেন—এসব কী? এরা কারা?
উজির মাথা নিচু করে বললেন—মহারাজ, এটা মুচিপাড়া।
—এখান থেকে এত কটু গন্ধ আসছে কেন?
—মহারাজ, এটা গরুর চামড়ার গন্ধ।
—গরুর চামড়া কেন? চামড়া দিয়ে কী হবে? রাজা চোখ কটমট করে উজিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। উজির ভয়ে ভয়ে বললেন
—মহারাজ, এরা গরুর চামড়া দিয়ে জুতা, ঢাক-ঢোল, ডুগি-তবলা, এসব তৈরি করে। এ কথা শুনে রাজা বেজায় রেগে গিয়ে মন্ত্রীকে ডেকে বললেন—কী, আমার রাজ্যে এমন কটু গন্ধ ছড়ানো হচ্ছে? আমি এসব সহ্য করব না। আজই এদের রাজ্য থেকে বের করে দিয়ে এখানে ফুলবাগান তৈরি করো। ফুল ফুটলে এখানে হাওয়া খেতে আসব।
রাজার আদেশ শুনতেই হবে। না শুনলে গর্দান যাবে। ওই দিনই সেপাই গিয়ে মুচিপাড়া খালি করল। কত মানুষের বাড়িঘর পুড়ল, কত সংসার ভাঙল তার কোনো হিসাব থাকল না।
মুচিরা কাঁদতে কাঁদতে অন্য দেশে চলে গেল।
এর কয়েক মাস পর রাজা আবার শিকারে বের হলেন। এদিকটা ঘন বন। বনের মধ্য দিয়ে অসংখ্য ছোট-বড় খাল বয়ে গেছে। খালের দুই ধারে শ্বাসমূল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বনটা গেওয়া, গড়ান, সুন্দরী গাছে ঠাসা। আছে গোলপাতা আর নাম না জানা অনেক অজানা গাছ। এই বন বাঘ, শজারু, শিয়াল, বেজি, হরিণের মতো হাজারো প্রাণীর আবাসভূমি। জলে আছে কুমির আর গাছের ডালে আছে পানকৌড়ি, বক, টিয়া, ময়নার মতো অনেক প্রজাতির পাখি। আছে চিত্রল হরিণ। রাজার ইচ্ছা হলো হরিণ শিকার করার। হরিণের কাছে যেতে বেশ কয়েকটা বড় খাল পার হতে হয়। রাজা হরিণ শিকার করার উদ্দেশে যেই না খাল পার হতে গেলেন, অমনি পায়ের একটা জুতা ছিঁড়ে কাদায় আটকে গেল। রাজা ভীষণ রেগে গিয়ে অন্যটা খালে ছুড়ে ফেলে মন্ত্রীকে হুকুম দিলেন, কী সব জুতা নিয়ে আসো, একটুতেই ছিঁড়ে যায়। যাও, এখনই নতুন জুতা নিয়ে আসো। তোমরা না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই এদের নিয়ে বসে থাকব। জুতা আনতে পাঠিয়ে দুষ্টু রাজা লোকজন নিয়ে সেখানেই বসে থাকলেন। রাজার জন্য বাঁশের মাচা তৈরি করা হলো। মাচার চারপাশে উঁচু করে তাঁবু টানানো হলো। রাতে মশাল জ্বালিয়ে সেপাইরা পাহারা দিতে থাকল। রাজা সন্দেশ রাজভোগ খেয়ে নাক ডেকে ঘুমাতে লাগলেন। রাতে মশালের আলো দেখে বনের পশু-পাখিরা ভয়ে পালাল। মশালের আগুন পড়ে শুকনা পাতায় লাগল আগুন। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। সে এক ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি হলো। আগুনের ভয়ে রাজা পাইক-পেয়াদা নিয়ে খালি পায়ে দিল দৌড়। রাতের অন্ধকারে লোকজন নিয়ে পড়ল এসে খালে। কাদামেখে ভূতের মতো হওয়া সেই রাজাকে যদি দেখতে, তোমাদের হাসি থামতই না। ওদিকে মন্ত্রী রাজার আদেশ পাওয়ামাত্র রাজ্যের চারদিকে লোক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সকাল থেকে বিকেল, বিকেল ঘনিয়ে রাত, রাত ভোর হয়ে আবার সকাল হলো। চারদিকে খোঁজ চলল। প্রতিটি শহরে, এমনকি গ্রামে গ্রামে খুঁজেও নতুন জুতা পাওয়া গেল না। রাজা ততক্ষণে জল-কাদা মেখে, নাস্তানাবুদ হয়ে, খালি পায়ে রাজবাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। এমনিতেই রাজার মেজাজ খুব খারাপ। তারপর মন্ত্রী খালি হাতে রাজার সামনে এসে মুখ নিচু করে যখন বললেন—মহারাজ, এ রাজ্যের কোথাও নতুন জুতা পাওয়া গেল না। মন্ত্রীর কথা শুনে রাজার চোখ আগুনের মতো লাল হয়ে গেল। রাজা সিংহের মতো গর্জন দিয়ে বললেন—গাধা, এক জোড়া নতুন জুতা আনতে পারলে না, তোমাকে আজই শূলে চড়ানো হবে।
গর্জন শুনে মন্ত্রী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাত জোড় করে বললেন—মহারাজ, মাফ করবেন। যে মুচিরা জুতা তৈরি করত, আপনার আদেশে তাদের রাজ্যছাড়া করা হয়েছে। এখন সোনার সিংহাসন পাওয়া গেলেও জুতা পাওয়া অসম্ভব।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন